বাংলাদেশের ‘সর্বোচ্চ গোলদাতা’ বিষয়ক বিতর্ক

আমি মনে করি, এ বিতর্কের সমাধান সেদিনই হবে, যেদিন আমরা কোনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর কোনটি নয়—এই সহজ পার্থক্যটা মাথায় ঢোকাতে পারব।

বাংলাদেশের ফুটবলে হালে একটা বিতর্ক খুব বাজার পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বা জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা কে? অনেকেই অনেক তথ্য দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, শেখ আসলাম, কেউ বলছেন আশরাফউদ্দিন চুন্নু; আবার অনেকেই বলছেন জাহিদ হাসান এমিলির নাম।

আমি মনে করি, এ বিতর্কের সমাধান সেদিনই হবে, যেদিন আমরা কোনটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ আর কোনটি নয়—এই সহজ পার্থক্যটা মাথায় ঢোকাতে পারব।

জাতীয় দলের জার্সিতে ম্যাচ, আর আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। জাতীয় ফুটবল দলের জার্সিতে অনেক ম্যাচই একজন খেলোয়াড় খেলেন। কিন্তু তাই বলে সব ম্যাচই কি আন্তর্জাতিক? সত্তর–আশির দশকে বাংলাদেশের আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট হতো। বাফুফে এগুলোকে বলত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট।

মেনে নিচ্ছি, এই ভেবে যে সে সব টুর্নামেন্টে বিদেশি দল খেলতে আসত। কিন্তু সেগুলো কী মানের দল, কোন দল—এসব নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন ছিল। আগাখান গোল্ডকাপ বা প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে কয়টা জাতীয় দল খেলে গেছে, এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন আছে।

বাংলাদেশের যে দল এই টুর্নামেন্টগুলোতে খেলেছে, সেগুলো কি আমাদের জাতীয় দল ছিল? এ প্রশ্নও আছে। প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপের কথাই ধরি। সেখানে সব সময় আমাদের দুটি দল খেলত। কখনো লাল–সবুজ কিংবা কখনো সাদা–নীল নাম দিয়ে দুটি দল খেলানো হয়েছে।

একটি দলে থাকতেন প্রতিষ্ঠিত জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা, অন্যটিতে অপেক্ষাকৃত উঠতি খেলোয়াড়েরা। ১৯৮৭ সালে সে আসরটি হয়েছিল, সেটাতে নীল দলে বেশিরভাগ ছিলেন আবাহনীর খেলোয়াড়েরা, সাদা দলে মোহামেডানের খেলোয়াড়েরা। ব্রাদার্স ও অন্যান্য ক্লাবের ভালো খেলোয়াড়দের ভাগাভাগি করে দুই দলে ফেলা হয়েছিল।

এই প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিরিয়া, চীনসহ ইউরোপের রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্রের দল কিংবা বিভিন্ন ক্লাব খেলেছে। ১৯৮৯ সালের প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে ভারতীয় জাতীয় দল খেলতে এসেছিল, কিন্তু এর বাইরে কখনো এসব টুর্নামেন্টে কোনো জাতীয় দল খেলেছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। হ্যাঁ, ’৮৯–তে থাইল্যান্ড জাতীয় দল পাঠিয়েছিল কিনা, সেটা নিয়ে আমি কিছুটা কনফিউজড।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ম্যাচে বাংলাদেশের অনেক তারকা খেলোয়াড়েরাই গোল করেছেন। কিন্তু সে গোলগুলো কি ‘আন্তর্জাতিক গোল’ হিসেবে ধরা যায়?

আমাদের তারকারা সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ম্যাচও খেলেছেন। এশিয়ান কাপ, বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, এশিয়ান গেমস ও সাফ গেমস ও সাফ ফুটবল এমনকি মালয়েশিয়ার আমন্ত্রণমূলক মারদেকা কাপ কিংবা ভারতের নেহেরু কাপে এই ম্যাচগুলো তাঁরা খেলেছেন।

‘বাংলাদেশ’ নাম নিয়ে যে ম্যাচগুলো অন্যকোনো দেশের জাতীয় দলের সঙ্গে খেলেছেন, প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী সেগুলোই আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ফিফাও তাই বলে। যে ম্যাচগুলো ফিফা অনুমোদিত, সেগুলোই আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সেখানেও একটা পার্থক্য অবশ্য আছে। বিশ্বকাপ বা এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ, কিংবা ফিফা অনুমোদিত প্রীতি ম্যাচের স্ট্যাটাস এক নয়, যদিও দুই ধরনের ম্যাচই আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

আমি মনে করি বাংলাদেশের কোন ফুটবলার এসব ম্যাচে কতগুলো গোল করেছেন—এই হিসাবটা বের করা খুব জরুরি, তাতেই গোল নিয়ে উটকো বিতর্কের সমাধান করা যাবে।

১৯৭২ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন ফুটবলার কয়টি ফিফা অনুমোদিত, খেয়াল করুন ‘ফিফা অনুমোদিত’ ম্যাচ খেলেছেন, সে তথ্য সত্যিকার অর্থেই আমাদের কারও কাছে নেই। বাফুফের কাছেও এ হিসাব থাকলে, আমি অবাকই হবো। আর্কাইভিং ও রেকর্ড সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বরাবরই একটা হেলাফেলার ব্যাপার আছে।

এই হেলাফেলাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কাজটা দ্রুত করতে হবে। এটা দেশের হয়ে খেলা একজন ফুটবলারের জন্যও অত্যন্ত জরুরি। মোনেম মুন্না, আশরাফউদ্দিন চুন্নু, কায়সার হামিদ কিংবা তারও আগে মনোয়ার হোসেন নান্নু, কাজী সালাউদ্দিনরা দেশের হয়ে কয়টা ম্যাচ খেলেছেন, এটা তারা বা তাঁদের পরিবার জানবে না, আমরা জানব না—এটা কখনো হয়, কোনো দেশে হয়েছে?

সাবেক ফুটবলারদের কৃতিত্বকে ওপরে তুলে ধরতে গিয়ে যারা অযথা অতি আবেগী হয়ে পড়ছেন, ভুলভাল, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিচ্ছেন, তাঁরা আসলে আমাদের অতীতের সে সব গ্রেট ফুটবলারদেরই ক্ষতি করছেন। এ প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তারা ছোট হচ্ছেন।

দক্ষিণ কোরিয়ার সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিপক্ষে গোল, থাইল্যান্ডের অনূর্ধ্ব–২১ দলের বিপক্ষে গোল, কিংবা চীন বা সিরিয়ার ক্লাবের বিপক্ষে গোল করলেই সেটাকে ‘আন্তর্জাতিক গোল’ হিসেবে ধরা যায় না—এটা মনে রাখা উচিত। একইভাবে কোনো খেলোয়াড় বয়সভিত্তিক ফুটবলে দেশের পক্ষে খেললে বা গোল করলে সেটিও যে আন্তর্জাতিক গোল বা ম্যাচ নয়, সেটিও মনে রাখতে হবে।

এ প্রজন্মের অনেক ফুটবলপ্রেমীকে আমি জানি, যাঁরা দেশের ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় দেখতে চান, তাঁরাও খুঁজে বের করতে চান অতীত দিনের গৌরব, কিন্তু এই প্রজন্ম যখন কোনো ফুটবলারের দক্ষিণ কোরিয়া, বা ফিনল্যান্ড বা সিরিয়া, চীনের বিপক্ষে গোলের হিসাব খুঁজতে গিয়ে দেখেন, সেটা জাতীয় দল তো দূরের কথা সে ধরনের মান সম্মত কোনো দলই ছিল না, তখন তাঁরা হতাশ হন, অতীতের গৌরবকে গৌরব মনে করেন না। তাঁদের কাছে অতীতের সেই খেলোয়াড়টিই খেলো হন।

বিজ্ঞ জনেরা এই বিষয়গুলো ভাববেন আশা করি!

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে কাতারে একটি আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট হয়েছিল। ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ’ নামের সে টুর্নামেন্টে ক্লাবদল মুক্তিযোদ্ধাকেই ‘বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। সে টুর্নামেন্টে ‘বাংলাদেশ’ নামে খেলা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ইয়েমেন জাতীয় দলকে ১–০ গোলে হারিয়েছিল। যদিও প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে তারা হেরেছিল ৪–২ গোলে। এই ম্যাচগুলো কিন্তু আন্তর্জাতিক ম্যাচ হিসেবেই গণ্য করা হয়।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...